Fathul Majid
ٱلزَّانِيَةُ وَٱلزَّانِى فَٱجْلِدُوا۟ كُلَّ وَٰحِدٍ مِّنْهُمَا مِا۟ئَةَ جَلْدَةٍ ۖ وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَأْفَةٌ فِى دِينِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْـَٔاخِرِ ۖ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَآئِفَةٌ مِّنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ
নামকরণ:
নূর অর্থ আলো। এ সূরাতে এমন কিছু বিধি-বিধান আলোচনা করা হয়েছে যা পালন করলে মানুষের জীবন প্রকৃতপক্ষেই আলোকিত হয়ে উঠবে। সে আখিরাতে চির সুখের উদ্যান জান্নাত লাভ করবে। যার কারণে উক্ত সূরাকে সূরা নূর বলে নামকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া নূর শব্দটি অত্র সূরার ৩৫ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
সূরা নূর সামাজিক বিধি-বিধানসম্বলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। সূরাতে ব্যভিচারের শাস্তি, লিআনের বিধান-পদ্ধতি, ইফকের ঘটনার সাথে জড়িতদের শাস্তি ও মু’মিনদের কর্তব্য, শয়তানের অনুসরণ থেকে সতর্কতা, অন্যের বাড়িতে প্রবেশের নিয়ম-বিধান, মু’মিন নর-নারীর দৃষ্টি সংযতকরণ ও সতিত্ব সংরক্ষণ, মহিলাদের পর্দার বিধান ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে। সূরার শেষের দিকে ঐসব মু’মিনদের আলোচনা করা হয়েছে যারা শত ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয় না ও তাদের বৈশিষ্ট্য, মুনাফিকদের সম্পর্কে আলোচনা এবং সমষ্টিগত মজলিসের আদব তুলে ধরা হয়েছে।
১-২ নং আয়াতের তাফসীর:
সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা বললেন: “এটি একটি সূরা যা আমি নাযিল করছি।” অথচ সকল সূরাই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে নাযিলকৃত। এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করার কারণ হল যে, এ সূরার বিধি-বিধানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে যা অবশ্য পালনীয়।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা অবিবাহিত নারী ও পুরুষের যিনা বা ব্যভিচার করার শাস্তি বর্ণনা করছেন। ব্যভিচার হলন শরয়ী পন্থায় বিবাহ বন্ধন ব্যতীত যেকোন নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ৪/২১) আয়াতে এ ব্যভিচারই উদ্দেশ্য এবং দলীল-সাক্ষ্যের আলোকে প্রমাণিত হলে হদ কায়েম করা হবে। এছাড়া মানুষের হাতের, পায়ের, কানের, মুখের ও চোখের ব্যভিচার হয়ে থাকে, সেগুলোর জন্য হদ কায়েম করা হবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৬২৪৩, সহীহ মুসলিম হা: ২৬৫৭)
ইসলামের নৈতিক মানদণ্ডে যে সকল আচরণ জঘন্যতম নৈতিক ও সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় তার মধ্যে ব্যভিচার নিকৃষ্টতম। ব্যভিচার এমন একটি মারাত্মক অপরাধ যা পারিবারিক জীবন-যাপন বিপর্যস্ত করে। একজন নারীর জীবনকে আজীবনের জন্য কলংকিত করে, মানুষের বংশনামা নষ্ট করে, সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে, সর্বোপরি আল্লাহ তা‘আলার কঠিন শাস্তিযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হয়।
ইসলাম এ শাস্তিযোগ্য ও জঘন্যতম অপরাধ প্রতিরোধে অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সামর্থ্য থাকলে বিবাহ করা, নিজ-নিজ দৃষ্টি সংরক্ষণ করা, নারীদের ঘরে অবস্থান করা, বাহিরে সৌন্দর্য প্রকাশ করে চলাফেরা না করা, মাহরাম বা স্বামী ছাড়া একাকি সফর না করাসহ অনেক ব্যবস্থা রয়েছে। সংক্ষিপ্ততার কারণে আলোচনা সম্ভব নয়।
ব্যভিচারের শাস্তি: ব্যভিচারের প্রাথমিক শাস্তি যা ইসলামে অস্থায়ীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল তা সূরা নিসার ১৫ নং আয়াত আলোচনা করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছেন যতক্ষণ এ ব্যাপারে কোন স্থায়ী শাস্তি নির্ধারণ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সে সমস্ত ব্যভিচারিণী মহিলাদেরকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হবে। কিন্তু সূরা নূরের এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: তোমরা আমার কাছ থেকে (ব্যভিচারী নারী-পুরুষের শাস্তি) শিখে নাও, আল্লাহ তা‘আলা তাদের স্থায়ী শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাহলন অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য একশত বেত্রাঘাত ও এক বছর দেশান্তর আর বিবাহিত হলে একশত বেত্রাঘাত ও রজম। (সহীহ মুসলিম হা: ১৬৯০) সুতরাং বুঝা গেলন ব্যভিচারী নারী-পুরুষ অবিবাহিত হলে একশত বেত্রাঘাত করতে হবে। এটা অত্র আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। একশত বেত্রাঘাতের সাথে এক বছরের জন্য দেশান্তর করতে হবে, যদিও এ ব্যাপারে তিনটি মত রয়েছে তবে এটিই সঠিক যা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (সহীহ বুখারী হা: ২৬৯৫-৬, সহীহ মুসলিম হা: ১৬৯৮)
আর বিবাহিত হলে একশত বেত্রাঘাত ও রজম তথা পাথর মেরে হত্যা করা। কিন্তু বাস্তবে তিনি বিবাহিত ব্যভিচারীদের শাস্তি দিয়েছেন পাথর মেরে, আর একশত বেত্রাঘাত (যা ছোট শাস্তি) বড় শাস্তির সাথে একত্রীভূত করে বিলুপ্ত করেছেন। অতএব এখন বিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচারের একমাত্র শাস্তি পাথর মেরে হত্যা করা। যদি একজন বিবাহিত হয়, অপর জন অবিবাহিত হয় তাহলে বিবাহিতের ওপর বিবাহিতের বিধান, আর অবিবাহিতের উপর হলে অবিবাহিতের বিধান কায়েম করা হবে। যা সহীহ বুখারী হা: ২৬৯৫-৬, সহীহ মুসলিম হা: ১৬৯৮ দ্বারা প্রমাণিত। এ শাস্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং বাস্তবায়ন করেছেন, খোলাফায়ে রাশেদী এ শাস্তি প্রদান করেছেন, পরবর্তীকালের ইমাম ও আলেমগণ সকলে এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। সুতরাং এ বিধানকে অস্বীকার করা বা বর্তমান যুগে উপযোগী নয় বা মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে উল্লেখ করা মূলত এ বিধানকে অস্বীকার করা, যা কুফরী কাজ।
অতএব যদি কোন নারী-পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তাহলে তাদেরকে শরীয়ত নির্ধারিত পন্থায় শাস্তি প্রদান করতে হবে।
তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার এ বিধান কায়েম করতে গিয়ে কোন প্রকার দয়া প্রদর্শন করা বা স্বজনপ্রীতি করা বা ক্ষমতাসীনদের ওপর বিধান কায়েম না করে শুধু দুর্বলদের ওপর কায়েম করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এটাকে আল্লাহ তা‘আলা ও আখেরাতের প্রতি ঈমানের সাথে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হাদীসে এসেছে: আয়িশাহ হতে বর্ণিত, কুরাইশগণ একদা মাখযুমী গোত্রের এক মহিলার ব্যাপারে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল, যে মহিলাটি চুরি করেছিল। এ ব্যাপারে কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মুখে কথা বলবে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রিয় পাত্র উসামা ব্যতীত এ ব্যাপারে কথা বলার দুঃসাহস কার আছে? তখন উসামা এ বিষয়ে তাঁর সাথে কথা বলল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তুমি কি আল্লাহ তা‘আলার হদ-এর ব্যাপারে আমাকে সুপারিশ করছ? তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাঁড়ালেন এবং খুতবা প্রদান করলেন। অতঃপর বললেন: তোমাদের পূর্ববর্তীরা, তারা ধ্বংস হয়েছে এজন্য যে, যখন তাদের মধ্যে সম্মানী লোকেরা চুরি করত তখন তাদেরকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দিত। আর যদি গরীব লোকেরা চুরি করত তাহলে তাদের ওপর হদ কায়েম করত। আল্লাহ তা‘আলার শপথ! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪৭৫, সহীহ মুসলিম হা: ১৬৮৮)
শাস্তি কায়েম করার শর্ত:
(১) ব্যভিচারকারীর স্বীকৃতি, অর্থাৎ ব্যক্তি যদি নিজেই স্বীকার করে যে, আমি ব্যভিচার করেছি, তাহলে তার ওপর বিধান কায়েম করা যাবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬৮১৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৩১৮)
(২) যে নারীর স্বামী নেই তার গর্ভবতী হওয়া। (সহীহ বুখারী হা: ৬৮২৯, সহীহ মুসিলম হা: ১৬৯১)
(৩) সাক্ষ্যদানকারীর সাক্ষ্য, তবে অবশ্যই চার জন ব্যক্তি সাক্ষ্য দিতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ يَرْمُوْنَ الْمُحْصَنٰتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوْا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَا۬ءَ فَاجْلِدُوْهُمْ ثَمٰنِيْنَ جَلْدَةً وَّلَا تَقْبَلُوْا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا ج وَأُولٰٓئِكَ هُمُ الْفٰسِقُوْنَ)
“যারা সতী-সাধ্বী রমণীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত কর এবং কখনও তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না; তারাই তো পাপাচারী।” (সূরা নূর ২৪:৪)
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, সা‘দ বিন উবাদা (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! যদি আমি আমার স্ত্রীর সাথে কোন পুরুষকে দেখি (অর্থাৎ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়) তাহলে কি আমি চারজন সাক্ষী উপস্থিত না করা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দিব? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: হ্যাঁ। (সহীহ মুসলিম হা: ১৪৯৮)
এমনকি যদি চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারে তাহলে যারা এ কথা বলবে তাদের ওপর হদ কায়িম করা হবে। তা হলন আশিটি বেত্রাঘাত করা। তবে সাক্ষ্যদাতা ব্যক্তির কয়েকটি শর্ত রয়েছে।
আর এ শাস্তি প্রদান করার সময় অবশ্যই মু’মিনদের একটি দল প্রত্যক্ষ করবে, যাতে মানুষ এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হয়।
১. বিধি-বিধানের দিক দিয়ে এ সূরাটি বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার।
২. আল্লাহ তা‘আলার বিধান ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে শান্তি ও শৃংখলা নিয়ে আসে।
৩. অবিবাহিত কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তাকে একশত বেত্রাঘাত করা হবে এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর করা হবে। আর যদি বিবাহিত হয় তাহলে তাকে রজম করে হত্যা করা হবে।
৪. হদ কায়েমের ব্যাপারে কোন প্রকার দয়া প্রদর্শন ও স্বজনপ্রীতি করা যাবে না।
৫. কেউ নিজে নিজের ব্যভিচারের কথা স্বীকার করলে সেক্ষেত্রে কোন সাক্ষীর প্রয়োজন হবে না।
৬. বৈধ স্বামী-স্ত্রী ব্যতীত অন্য সকল প্রকার নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক ইসলামে হারাম।
৭. শাস্তি প্রদানের দৃশ্য মিডিয়াতে প্রচার করা উচিত, যাতে মু’মিনগণ তা প্রত্যক্ষ করে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।